ঝালকাঠি গাবখান ট্রাজেডি
ঝালকাঠি প্রতিনিধি :
ঝালকাঠির ৫ম চীন মৈত্রী সেতু (গাবখান সেতু) দিয়ে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা সবাই জন্মপ্রতিবন্ধী শহিদুল(৪৬) কে চিনতেন। হাত পেতে ভিক্ষা নিতেন তিনি।কিন্তু গত ১৭ এপ্রিল সেতু এলাকায় ট্রাক দুর্ঘটনায় নিয়তির বেড়াজালে থেমে গেছে সব কিছু।একটি দুর্ঘটনায় এলোমেলো হয়ে গেছে একটি পরিবারের সব স্বপ্ন। টোলে আর ভিক্ষা করবে না জন্ম প্রতিবন্ধী শহিদুল।ঘাতক দানবীয় ট্রাকের নিচে পরে প্রান হারিয়েছেন তিনি।
প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্ম নিয়ছিলেন
প্রতিবন্ধী শহিদুল খান (৪৬)। বাবা ঝালকাঠি শহরের অতি পরিচিত মুখ বাদশা খান।পেশায় নৌকার চালক হওয়ায় তাকে বাদশা মাঝি নামেই চিনত।
ঝালকাঠির অতুল মাঝির খেয়াঘাট আর গাবখান নদীতে সে খেয়া নৌকা চালাতো।বাবার মৃত্যুর পর ঝালকাঠির গাবখান ফেরিঘাটে ও ফেরিতে ভিক্ষা করা শুরু করেছিল শহিদুল।
শহিদুলের বয়স যখন আট বছর,সেই থেকে ঝালকাঠির বিলুপ্ত গাবখান ফেরিঘাটে ও ফেরিতে ভিক্ষা করা শুরু করেন।শহিদুলের মানসিক অবস্থা ভালো থাকলেও তার দু’পা ছিলো বিকলাঙ্গ। হাতে ভর করে পাছায় টিউব বেধে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভিক্ষা করে সংসার চালাতো শহিদুল খান । তার আপন দুই ছোট ভাই সাইদুল ও সাদ্দাম সেতুর টোল প্লাজার কর্মী হিসেবে কাজ করে।২০০১ সালে গাবখান নদীর উপরে সেতু চালু হবার পরে ঝালকাঠি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন রূটে চলাচলকারী গাড়িতে ভিক্ষা করতেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দৈহিক গঠন বৃদ্ধিতে শরীর ভার হলে কলেজ মোড়ে ভিক্ষা করতো। সেখান থেকে আকলিমা মোয়াজ্জেম কলেজের সামনে এবং সর্বশেষ গাবখান টোলপ্লাজায় স্পীড ব্রেকারের পাশে বসে ভিক্ষা করতো।গত ৪/৫ বছর যাবৎ সে নিয়মিত ভিক্ষা করতো গাবখান সেতুর পূর্বপাড়ে টোল প্লাজায়।
ভিক্ষার আয়ে চলতো শহিদুলের সংসার। প্রতিবন্ধী হলেও শহিদুলকে ভালোবাসতে ও শ্রদ্ধা করতো এলাকাবাসী সবাই। তার আচরণে মুগ্ধ ছিলো ভিক্ষাদানকারীরাও।
দুর্ঘটনার দিন গত বুধবার দুপুরে প্রতিদিনের মত রামনগর গ্রামের বাড়ি থেকে মাত্র দুইশগজ দূরত্বে গাবখান সেতুর টোলের উত্তর পাশে ভিক্ষা করছিল শহিদুল। একটি সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি প্রাইভেটকার ও ৩টি অটোরিক্সাকে চাপা দিয়ে ওখানে বসে থাকা শহীদুলের উপর দিয়ে খাদে পড়ে গেলে সেখানে গুরুতর আহত হয় প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক শহিদুলও।দ্রুত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল ৪টার দিকে সে মারা গিয়ে সব কিছুর উর্ধ্বে চলে যায়। সড়কে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আরেকটি নাম। কোনদিন দেখা যাবেনা শহিদুলকে ভিক্ষা করতে গাবখান সেতুর টোলে।বুধবার দুপুর একটার দিকে এক বাস চালক তাকে ১৫ টাকা ভিক্ষা দিলে তিনি মুচকি হাসেন। এটাই ছিল তার শেষ ভিক্ষা। সেই হাসিতেও ছিলো বিষন্নতার একটা ছাপ।হয়ত তিনি মৃত্যুদুতের আগমন বুঝতে পেরেছিলেন।
স্বজনরা তার মৃতদেহ শনাক্ত করলে পরিবারের আপত্তি থাকায় কোন পোষ্টমর্টেম ছাড়াই পুলিশ পরিবারের কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করে। বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল সকাল ১০ টায় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় শহিদুলের মৃতদেহ।
৩০ বছর বয়সে শহিদুল সদর উপজেলার নেছারাবাদ গ্রামের শ্রমিক আশ্রাফ আলীর মেয়ে হেলেনাকে বিয়ে করে শহিদুল। দাম্পত্য জীবনে শহিদুলের আড়াই বছর বয়সী সায়মা আক্তার নামে এক কন্যা সন্তান রয়েছে।
শহিদুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী হেলেনা বেগম স্বামী হারানোর শোকে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। আড়াই বছর বয়সী ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বিলাপ করে বলছেন ” আল্লাহরে এখন আমার কি হবে, মনুরে লইয়া কোন পথে যামু, কেমনে বাঁচমু। ও আল্লাহ তুমি এ কেমন বিচার করলা !
টোল কর্মী ছোট ভাই সাদ্দাম বলেন, আমি বুধবার টোলের ডিউটি শেষ করে দুপুরে খাবারের জন্য বাড়িতে আসার পরে গোসলে যাই। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। পরে দৌড় দিয়ে টোলের সামনে গিয়ে দেখি আমার ভাই ঘাতক ট্র্রাকের নিচে চাপা পড়ে আছে। স্থানীয়রা তাকে ট্রাকের নিচ থেকে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পরে তাকে উদ্ধার করে বরিশাল শেবাচিমে নিয়ে গেলে ডাক্তারা চিকিৎসার চালায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থা ভাই আমাদের ছেড়ে চলে যায়। ভাই আর কোনদিন ফিরেও আসবে না, আর মানুষের কাছে হাতও পাতবে না।