মোঃ সিরাজুল মনির, চট্টগ্রাম ব্যুরো :
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে আড়াই মাস খুনোখুনির খবর পাওয়া না গেলেও ফের রক্তাক্ত হলো পাহাড়। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকালীন আঞ্চলিক দলের নেতাকর্মীকে গুলি করে হত্যা, পাল্টাপাল্টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ি জনপদে। সর্বশেষ গত শনিবার রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) এক কর্মীসহ দুজনকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্ত।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে বিগত ছয় মাসে রাঙামাটি–খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের ১১ নেতাকর্মী–সমর্থককে প্রাণ হারাতে হয়েছে দুর্বৃত্তের গুলিতে। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের অনিলপাড়ায় গুলি করে ইউপিডিএফের চার নেতাকে হত্যা করা হয়। ওই সময় প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা যান ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহসভাপতি লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফ সদস্য রুহিন ত্রিপুরা। পানছড়ির চার খুনের দেড় মাসের মাথায় ২৪ জানুয়ারি জেলার মহালছড়ি উপজেলায় আরো দুজনকে হত্যা করা হয়। তখন মারা যান ইউপিডিএফ সদস্য রবি কুমার চাকমা ও শান্ত চাকমা ওরফে বিমল। ৪ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় আরো দুজন খুন হন। তারা হলেন ইউপিডিএফ সদস্য দীপায়ন চাকমা ও আশুক্য চাকমা ওরফে আশীষ। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে একই উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নে ঘাতকের বুলেটে খুন হলেন ইউপিডিএফ কর্মী নিপন চাকমা। সর্বশেষ গতকাল দুজন খুন হন। এ নিয়ে ছয় মাসের মধ্যে খাগড়াছড়িতে ৬ জন ও রাঙামাটিতে ৫ জন প্রাণ হারান।
এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাহাড়ে বিবাদমান আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) এবং ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করে আসছে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। তবে তিনটি সংগঠনই এসব হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
সর্বশেষ লংগদুতে ডাবল মার্ডারের ঘটনাকে ‘কাপুরুষোচিত’ ও ‘ন্যক্কারজনক’ মন্তব্য করে ইউপিডিএফ রাঙামাটি ইউনিটের সংগঠক সচল চাকমা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ইউপিডিএফের নেতৃত্বে সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০ (পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমালা) বাতিলের ষড়যন্ত্রসহ বান্দরবানে বম জাতিসত্তার ওপর নিপীড়ন–নির্যাতনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে এবং সরকারের কৃপা লাভের আশায় সন্তু লারমা আবারো তার খুনি বাহিনীকে দিয়ে ইউপিডিএফের কর্মী–সমর্থকদের ওপর হত্যাকাণ্ড শুরু করেছেন। পাহাড়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ হচ্ছে। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে আত্মপ্রকাশ করেছিল প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফের সঙ্গে জেএসএসের ‘অঘোষিত ঐক্য’ হয়েছে।
ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, পাহাড়ের নির্বাচনগুলোতে পার্টির অবস্থান থাকে। এবারও কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে পার্টি। আমরা বিভিন্ন উপজেলায় জেএসএসের সমর্থিত প্রার্থীকেও সমর্থন দিয়েছি। তার মানে এই নয় যে আমরা জেএসএসকে সমর্থন দিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মতাদর্শিক বিরোধ আগের মতো রয়েছে। জাতীয় স্বার্থে বা বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে পার্টি কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে; যাতে করে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতসহ অন্য সমস্যাবলির সমাধান আসে।
নতুন খুনে পুরনো স্মৃতি : ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের কংলাক, মাচালং ও বাঘাইহাট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালেট পেপার, সরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে নির্বাচনী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনায় ভোটগ্রহণ কাজে নিয়োজিতসহ মোট আটজনের মৃত্যু হয়। এ হামলায় পাহাড়ের তিনটি আঞ্চলিক দল একে অপরকে দোষারোপ করেছিল। এবারের ভোটেও বাঘাইছড়ি উপজেলায় পাহাড়ের বিবাদমান চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল দ্বি–পাক্ষিক অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্যে জেএসএস–ইউপিডিএফ একটি পক্ষ এবং জেএসএস (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) আরেকটি পক্ষ। দৃশ্যত দুই গ্রুপে চার দলে বিভক্ত পাহাড়ের আঞ্চলিক দলসমূহ।
এবারের উপজেলা পরিষদ তথা স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নে দুই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র শাখার মধ্যকার পাল্টাপাল্টি গুলি বর্ষণের খবর পাওয়া গেছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ বলেন, ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে রাঙামাটির চারটি উপজেলায় নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ভোটেও যেন এমন পরিবেশ বজায় থাকে সেজন্য আমরা বিভিন্ন উপজেলায় যাচ্ছি। নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা আশা করছি এবারের ভোটে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সজাগ রয়েছে, কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যাতে বিঘ্নিত না হয়। গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।